Eakdin Bohudin
By
Mahadi Hasan
By
Mahadi Hasan
তখন আমাদের বাড়িটা ছিল অন্যরকম। আমার জ্যাঠার পরিবারটা তখন এই সাবেক বাড়িতে ছিলেন। বাড়িতে ছয়টা থাকার ঘর, তিনটা গোয়াল ঘর, ও দুইটা রান্নাঘর ছিল। তিনটা পরিবারের বাস। আমাদের পরিবারটাই ছিল সবচেয়ে ছোট; বাবা, মা আর আমি। আমার আপন জ্যাঠার পরিবারে তখন পাঁচজন লোক। আমার অন্য জ্যাঠার পরিবারেও পাঁচজন লোক। বাড়িটা সবসময় মানুষে সমাগম থাকত।
আমার আপন জ্যাঠার পরিবারটা আর আমাদের পরিবার মিলে একটা রান্নাঘর, একটা গোয়ালঘর, গোয়ালঘর আবশ্য দুইটা; একটা বড়, একটা ছোট; গাভী গাভীন হলে ছোটোটাতে রাখা হতো, একটা কূপ ও একটা নলকূপ। তখন আশেপাশের কয়েক বাড়ির মধ্যে কেবল আমাদের নলকূপ ছিল। কূপটা শানে বাঁধানো; অবস্য নলকূপ বসানোর পর সেটা ধীরে ধীরে বাড়ীর আর্বজনা ফেলে ভরাট করা হয়েছিল। কলের পাড়ে ছিল একটা পেয়ারা গাছ, একটা পেপেগাছ আর উত্তর পার্শে আমাদের থাকার ঘরের পেছনে ছিল একটা কাঁচা ল্যাট্রিন তার দেয়াল ছিল মাটির।
রান্নাঘরটা ছিল কলেপাড়ের সঙ্গে লাগিয়েই দক্ষিণ পাশে আর তার কিছুটা পেছনে একটা নর্দামা; বাড়ির কূপের নর্দামা, বেশ বড় ও চারদিক বাঁধানো; সেখানে পানি জমে থাকত, শেওলা জন্মাতো ও ব্যাঙ্গের লাফ দেখতে মজা পেতাম আমরা।
আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল হোট বাঁশবন আর আমাদের চত্তর পেরিয়ে উত্তর পাশে আমার অন্য জ্যাঠার চত্তরে ছিল একটা বেশ বড় কাঠালগাছ আর তার পাশে সুউচ্চ দুইটি সুপারির গাছ। পাশের গ্রামের লোকেরাও দেখতে পেত সেই সুপারির গাছের মাথা।
আমাদের বাড়ির গেটটা দক্ষিণ দুয়ারী। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠান, তারপর একটু পশ্চিমে গিয়ে সরু রাস্তা দক্ষিণে চলে গিয়ে মূল রাস্তার সঙ্গে লেগেছে। রাস্তাটা চতরাহাট হতে খালাশপীর হাট, অর্থাৎ আমাদের বাড়িটা রাস্তার পাশে। এই সরু রাস্তা থেকেই আমাদের বাড়ির সীমানা শেষ। তার পশ্চিমে বুড়ো করমতের আমগাছের বাগান ও পুকুর। পুকুরটা আমগাছের পশ্চিমে; পাশাপাশি কয়েকটি আমগাছ। আমগাছের নিচের জমিটা নিচু, বর্ষাকালে আমাদের বাড়ির পানি নেমে গিয়ে সেখানে পানি জমে থাকতো প্রায় হাটুখানেক। তখন আমাদের কয়েক বাড়ির শিশুদের আনন্দ আর ধরতো না। সেই পানির মধ্যে খেলতাম, দৌড়াতাম, কাগজের নৌকা এবং এটা সেটা ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াতাম তার মধ্যে আর হইচই চলতো।
আমাদের বাড়ির পেছনে যে বাঁশঝাড়টা তার পাশে ছিল একটা জিগার গাছ। সেই জিগার গাছ হতে গাড় আঠা পড়ে ভরে থাকত মাটিতে। সকালবেলা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চারা তাতে পড়ে গিয়ে নাজেহাল হত, উঠতে পারত না। সেই জিগার গাছের কাছে ও বাঁশঝাড়ের অপর পাশে আমার জ্যাঠার ঘরের পেছনে এই দুই জায়গায় থাকত দুইটা খড়ের গাদা। একবার আমি ছেলেদের সঙ্গে খেলতে খেলতে দৌড়াদৌড়ি করে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে খড়ের গাদা ও বাঁশঝাড়ের সন্ধিস্থলে ছোট সুন্দর জায়গায় শুয়ে পড়লাম খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে এবং সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম। কে যেন দেখতে পেয়ে আমার মাকে এসে জানায়। আমার মা আমার কাছে গিয়ে আতঙ্কিত হয়ে আমাকে ডাক দিলেন তাতে ঘুম ভেঙ্গে আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
ছোট বেলায় একবার আমার একটা মরণরোগ হয়েছিল। একটা রোগ চিনতে ভুল করে ডাক্তার দিয়েছিলেন কৃমির তরল ঔষধ। তাতে আমার রোগ অন্য পর্যায়ে পৌছে যায়। আমার সেই রোগ রূপ নিয়ে হয়ে যায় কিডনির রোগ। দিনদিন রোগ বাড়তে থাকে। কত চিকিৎসা কিন্তুু কিছুতেই কিছু হল না। শেষে একদিন আমার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেল। পেট ও সারা শরীর ফুলে গেল, শরীরের চামড়া ফেটে গিয়ে রস পড়তে লাগল। শেষে আর কোন চিকিৎসা বাকি থাকল না। বাড়িতে কান্নাকাটি উঠে গেল; কোরবানী মানস হলো। শেষে এলেন চতরার এক ডাক্তার। একটা ঔষুধ দিলেন; বললেন,“এই ঔষুধ খাওয়ার পর যদি ঘুমিয়ে পড়ে এবং রাত্রে প্রস্রাব করে তাহলে বাঁচার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে আর কোনো চিকিৎসা দেখছি না। আমি ঔষধ খেলাম, সারাদিনের যন্ত্রণা যেন বিলীন হয়ে গেল, গভীর ক্লান্তি এলো শরীরে, ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। গভীর ঘুমের জগতে গেলাম। আমার বাড়ির সকলেই জেগে ছিলেন সেই রাতে আমাকে পাশে নিয়ে। অবস্থা বেগতিক শুনে নানাও এসেছিলেন, আমার পাশে বসেছিলেন। মাঝরাতের একটু পর আমার ঘুম ভাঙ্গল। চোখ খুলে দেখি পাশে আমার নানা, আমার বাবা, মা ও অন্যরা। আমি যেন মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম। আমার এই চোখ খোলাতে সহস্র আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল সকলের অন্তরে। আমাকে ঘুম থেকে তুলে দেখলেন ভিজে গেছে বিছানা প্রস্রাবে। সেই তখন কেটে গেছে আমার জীবনের একটি ভয়ঙ্কর অধ্যয়। তারপরও বহুদিন ধরে বুজুরি সিরাপ খেয়েছি সেই রোগ থেকে চিরমুক্তির জন্য।
বাড়ির লোকদের কথা বলি। আমার জ্যেঠাতো ভাই মেস্তাফিজ ও অন্য জ্যোঠার ছোট ছেলে এনামুল ভাই; তারা পাথারে যেতেন গরু, ছাগল, ভেড়াগুলোকে বাঁধতে, ঘাস খাওয়াতে। যাওয়ার সময় সঙ্গে নিতেন আমাকে কিন্তুু আমি পড়তাম মহাযন্ত্রণায়; মোস্তা ভাই গরু-ছাগল বাঁধবেন একট জায়গায় আর এনামুল ভাই বাঁধবেন অন্য জায়গায়। তারা আমার সঙ্গে জেদ লাগাতেন আর আমি পড়তাম থতমতে; আমি কার সঙ্গে যাই, দু’জনের কেউ ছাড়ে না। শেষ পর্যন্ত যেতাম এনামুন ভাই এর সঙ্গে কারণ সে ছাড়ত না কিছুতেই। তখন যেতে যেতে মোস্তা ভাই বলতেন,“পুচকি পরে দেখিস মজা!”
গ্রামে আখ-মাড়াইয়ের সময় আসতো। আখের চাষ হত। সেই আখের গুড় তৈরী হত কত কঠিন পদ্ধতিতে। দিনরাত গরু দিয়ে কল ঘুরিয়ে আখের রস বের করা হতো। তাহা পাক করা হত কত বিরাট এক কড়াইয়ে; সে চুলাটা ছিল প্রায় একটা কুয়ার সমান আর প্রসারিত। তখন আমি সেসব দেখতাম আর অবাক হতাম।
মাঝে মাঝে বছরে দু’একবার আমার জ্যোঠাতো বোন ফিরোজা ঢাকা থেকে বেড়াতে আসতেন আমার ভাগ্নে-ভান্নিদের সঙ্গে নিয়ে। তখন আমাদের বাড়িতে প্রায় উৎসবের শুরু হত। তাদের সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াতেন মোস্তা ভাই সঙ্গে থাকতাম আমিও। মাঠে যেতাম, শীতের সময় আখের খেত তখন কাটা শুরু হত; আখের জমি ভরে থাকত ফুলে ফুলে। আমরা সেই লম্বা ফুলগুলি কয়েকটি করে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম।
বাড়ির পূর্ব পাশের থাকার ঘরটিতে থাকতেন মাহফুজ ভাই। সে লেখাপড়া করত। তার ঘরে থাকত ইয়া বড় ক্যালেন্ডার; বাংলাদেশের মানচিত্র তাতে। আমি এসব বুঝতাম না, আমি মনে করতাম পুরো বাংলাদেশটি দুইটা প্রাণি। উপরেরটা বড় প্রাণি এবং নিচেরটা ছোট প্রাণি; নিচেরটা মানে পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সবাজার নিয়ে গঠিত অংশটি, এবং বলতাম বড় প্রাণিটি ছোট প্রাণিটিকে ধরে খাচ্ছে। আমার এই অদ্ভুত কথা শুনে মোস্তা ভাই আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতেন; বলতেন,‘পুছকি এটা বংলাদেশের ম্যাপ।
তখন বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে জমিতে পানি আটকানোর ও হাল দেওয়ার ধুম পড়ে যেত। পুরো মাঠে মানুষ কাজে মেতে উঠত। মোস্তা ভাই এর সঙ্গে মাঠে গিয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে এসব দেখতাম। কত মানুষ সারা মাঠে কাদার মধ্যে কাজ করছে। কতগুলি চাষী হাল নিয়ে এসেছে। জমি কাদা করা হচ্ছে। চারদিক নীরব, শান্ত; মাঝে মাঝে কিছু চাষীর গরু তাড়ানোর ডাক“এই জোরে-ঐ-জোরে, হট-ডান-ডান”। এসব দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম।
আমি খুব ছোট থাকতে বাবা-মা একবার ঢাকায় গিয়েছিলেন আমার জ্যোঠাতো বোনের বাড়িতে বেড়াতে। যাওয়ার দিনে লঞ্চে অন্ধকার জমেছিল। আমি ভয় পেয়েছিলাম। একজন কালো কোর্ট ও কালো চশমা পড়া লোককে দেখেছিলাম, মনে পড়ে। অতিরিক্ত যাত্রি বহনে লঞ্চটা বিপর্যয়ে পড়ার মতো দশা। বাবা যমুনা নদীতে সারাটা সময় দোয়া পড়েছিলেন। সেদিন বাস ধর্মঘট ছিল। যমুনা পার হয়ে বাস পাওয়া যাচ্ছিল না। পূর্বের আসা বাসটি রাজনৈতিক মাস্তানরা অপর পাড়ে আটকে রেখেছিল। শেষে বহু কষ্টের পর একটা বাস পাওয়া গিয়েছিল সেটা আবার লোকজনে পরিপূর্ণ। আমাকে কোলে নিয়ে তাদেরকে দাড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। তারপর বহু কষ্টে ঢাকায় পৌছেছিলেন। ঢাকায় গিয়ে খেলতাম ফয়সালের সঙ্গে, সে আমার ভাগ্নে; বয়সে বড়, তার বেশ সুন্দর সুন্দর খেলনা ছিল। ঢাকায় আমাদের সঙ্গে মাফুভাই গিয়েছিলেন। তিনি বজ্জাতি করে আমার একটা ল্যাংটা ছবি তুলেছিলেন তাদের বাসার ক্যামেরায়। সেটা প্রিন্ট করে নেওয়ার পর সকলে দেখে হেসেছিল।
আমার জ্যোঠাতো ভাই মোস্তাফিজ ও এনামুল কাঠালপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। সকাল হলে যখন সূর্য উঠত তার কিছু পরে গ্রামের কিছু ছেলে রওয়ানা হত স্কুলে। কাঠালপাড়া প্রাথমিক স্কুল আমাদের গ্রাম থেকে পশ্চিমে এক কিলোমিটার দূরে। একদিন সেখানে পিকনিক হল। আমি এনামুল ভাইয়ের কাছ থেকে শোনামাত্র তার সঙ্গে জেদ ধরলাম আমিও সঙ্গে যাব। বৃষ্টির দিন, তাই তিনি আমাকে নিয়ে যেতে ইতস্ত বোধ করছিলেন কিন্তুু আমি ছাড়ছি না। এনামুল ভাই এর উপর ভার পড়েছিল ভাত পাকানোর হাড়ির। তাই তিনি একটি হাড়ি ও একটি প্লেট নিয়ে চললেন এবং আমিও তার সঙ্গে চললাম একটি প্লেট হাতে নিয়ে। পিকনিকের রান্না শেষ হল কিন্তুু খাওয়ার সময়ে বৃষ্টি শুরু হল। তখন সকলে স্কুলের ভেতরে ঢুকে খেতে লাগল। টিনের ফুটো দিয়ে পানি পড়ছিল। যে যেটুকু নিয়েছিল তার বেশি দ্বিতীয়বার নিতে পারল না। বৃষ্টির মধ্যে সবাই বেঞ্চে উপরে পা তুলে বসে যে যার মত খাওয়া শেষ করল। ভাত ও মাংশ বেশি হয়েছিল; সেগুলো কিছু অন্যদের দিয়ে বাকিটা এনামুল ভাই ও অন্য একটা ছেলে মিলে হাড়ি ধরে নিয়ে বাড়িতে এলেন। আমি স্কুলে বেশি খাইনি, মাত্র একটু। বাড়িতে খেতে বললেও খেলাম না। আমাকে বললেন,“কিছু তো খাইলিই না শুধু শুধু জেদ ধরলি”। আসলে খাওয়া না আমি আনন্দিত হয়েছিলাম পিকনিক দেখতে পেয়ে। পিকনিক কি রকম তা দেখার জন্যই আমি উদগ্রীব হয়েছিলাম আর দেখতে পেয়ে নন্দিত হয়েছিলাম।
শৈশবের একটা বন্যার কথা আমার বেশি মনে পড়ে। যখন আমি ছোট ছিলাম; ১৯৯৮ সালের বন্যা। আমাদের বাড়ির উঠানে পানি জমেছিল। বাড়ির পেছনে এক হাটুর চেয়ে বেশি পানি; বাড়িতে এক বিঘত। ঘর ছেড়ে আমরা বাহিরে চৌকি ফেলে থাকতাম। ঘরের চারদিকে বন্যার জল, কখন বিপদ আসে বলা যায় না, তাই রাতে থাকা হতো বাহিরে সেই চৌকিতে। বাড়ির আঙ্গিনায় দু’তিনটা চৌকি, একটায় আমরা থকতাম আর অন্যগুলোতে আমার জ্যাঠার পরিবার। চারদিকে জল। সেই চৌকি থেকে দুইটা লম্বা বেঞ্চি মাথামাথি জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল বারান্দার সঙ্গে। মাত্র ইঞ্চি খানেকের জন্য বারান্দায় পানি উঠেনি। আমি সেই বেঞ্চি দিয়ে ঘরে আসতাম বারান্দায় বেড়াতাম আবার চৌকিতে যেতাম। মা-বাবা আমাকে নিয়ে ভিষণ চিন্তায় ছিলেন ঐ সময়। চারদিকে জল। আমাদের ছিল প্রায় দশ মণ গম ও বিশ মণ ধান; ধান গমগুলো পাশের গ্রাম যাদবপুরে রেখে আসা হয়েছিল। গরুগুলো কাঠালপাড়া স্কুলে রেখে আসা হয়েছিল। সেখানে গরু দেখাশোনা করতেন আমার এক চাচা; সে আমাদের বাড়িতে কাজ করতো এবং সম্পর্কে চাচা ছিল। সেই স্কুলঘরে আরও বহু লোকের গরু বাছুর ছিল সেবার বন্যাতে, বহু দূর্ভোগ পোহতে হয়েছে সেবার।
মাঝে মাঝে যখন বেশি কাজ থাকতনা সেই অবসর সময়ে আমার মা আমাকে নিয়ে নানার বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। নানার বাড়ি আমার কাছে মধুর লাগত। কয়েকদিন থাকার পর কোন এক রাত্রে ফজরের সময়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। তাকিয়ে দেখতাম উপরে ছাদের নিচে টাঙ্গানো চান্দা, নকশী কাপড় দিয়ে তৈরী। মাকে জিজ্ঞেস করতাম “মা আমরা কখন বাড়ি যাব”। এরই মধ্যে হয়ত বাবাও যেতেন বেড়াতে। বাবা গিয়ে সাইকেলটা থামাতেন সেখানে যেখানে গোয়াল ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের কোণটা ছিল।
গ্রামের মাঠের কথা বলি। তখন সবেমাত্র ইরি মৌসুমের ধানের চাষ শুরু হয়েছে। আমাদের একটা শ্যালো মেশিন কিনেছে। পুরো মাঠ মিলে কয়েকটা শ্যালো মেশিন। মাঠের প্রকৃতি বদলে গেল। ইরির মৌসুমে সারা মাঠ ফাকা, শীত, শীতল সাতাস। ক্রমান্বয়ে গ্রামে শ্যালো মেশিনের সংখ্যা বাড়তে লাগল; ইরি চাষও প্রসারিত হতে লাগল। আবার শীতের সময় কত সুন্দর দেখাতো শীতকালীন সবজি দিয়ে ভরা ফসলের মাঠটি। তিল, তিশি, সরিসার ক্ষেত্রে অপরূপ সৌন্দর্য ছড়াতো ফুলে ফুলে ভরে গিয়ে; তাতে থাকত কত প্রজাপতির বাহার। সুন্দর লাগত পেয়াজ ও মুলার ফুলগুলিও।
বর্ষণমুখর দিনের কথা বলি। আমি বর্ষা কি? বা বৃষ্টি কি তাহা যতদিন জ্ঞানে ছিল না ততদিন তো কিছুই বুঝতাম না, তবে যখন বুঝে এলো তখনকার প্রথম বৃষ্টির দিনের কথাটা বলি। সকালে বৃষ্টি শুরু হল, আমি দেখে আশ্চর্য হলাম এবং মনটা ভীষণভাবে খারাপ হয়ে গেল, ‘এটা কি হচ্ছে!’। পরে যখন ব্যাপরটা বুঝতে পারলাম তখন মনটা ভাল হয়ে গেল।
আমার জ্যোঠার বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে যাওয়ার সময়টা ছিল গৃস্মের শেষ ও বর্ষার শুরু। তারা তাদের ঘর থেকে টিন খুলে নিয়ে গেলেন এবং আমাদের একটি ঘরের টিনগুলোও অকেজো হয়েছে, তাই বাবা ঠিক করলেন দুইটা ঘরেই নতুন টিন দিবেন। তখন মিস্ত্রি এনে অন্য ঘরটারও টিন খুলে ফেললেন। সেদিন রাতে বৃষ্টি শুরু হল। আমাদের অন্য ঘরটা যেটায় আমি থাকতাম সেটার টিন ছিল ভাল, সেটার টিন খোলা হয়নি। টিন খোলা ঘরের ছাদের উপরে বাবা টিন বিছিয়ে দিয়েছিলেন; তবুও রাতে পানি ঢোকায় অন্য ঘরটাতে চলে আসতে হয়েছিল। তখন আমার ছোট ভাইটা ছিল কোলের ছেলে। আমার মা ছিল তাকে নিয়ে মহাসমস্যায়।
ঋতুচক্রে শীত আসে। শীতের সময়ে বাড়ির সকলে মিলে আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে বসে গল্প শুরু হত। এসময় গরু চুরি হত; কোথায় কোনদিন রাতে কার গরু চুরি হয়েছে তার গল্প, হাটে কোন জিনিসের বাজার কত গেছে তার গল্প, কার কোন ফসল কেমন হয়েছে তার গল্প, আরও কত গল্প। তারপর রীতি হয়ে উঠতো সকাল ও দুপুর রোদে বসে ভাত খাওয়া। শীতে জমত পিঠার উৎসব; নারকেল পিঠা, ভাপা পিঠা আরও কত পিঠা খাওয়া হত।
আমাদের বাড়িতে থাকার ঘরকটা ছাড়া বাকি ঘরকটা এবং আশেপাশের বাড়ির সকল ঘর ছিল খড়ের চালার। হেমন্তে যখন ধানের কাজ শেষ করার পর চারদিক ঘর মেরামতের ধুম পড়ত তখন আমাদের এক নতুন অনুভূতি জাগত। হেমন্তে নবান্ন উৎসব হত; মিলাদ পড়ানো হতো বাড়ি বাড়ি। কত সুন্দর লাগত সেই মিলাদের সুর। নীল-কোমর নামে যে ধানটি তখন চাষ করা হত তার নতুন ভাতের সুগন্ধে ঘরদোর বিমোহিত হতো। আর সেই নবান্নের পায়েশ কত মধুরই না ছিল।
আমাদের গ্রামের মধ্যে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে তার কথা বলি। সেটা ছিল কাচা রাস্তা। রাস্তায় জমে থাকত প্রচুর ধুলো। আমরা ধুলো দিয়ে খেলতাম। আবার বর্ষাকালে সেই রাস্তায় কাদাও হতো প্রচুর। একবার এক কালবৈশাখির প্রবল বর্ষনে সেই রাস্তার সব ধুলো এমনভাবে উড়ে গিয়ে ও বৃষ্টিতে ধুয়ে নিচে নেমেছিল যে পরের দিন সকালে রাস্তাটা ছিল ফাটা। সেই রাস্তাটাকে সেবারেই আমি জীবনে একবার ধুলাশূন্য দেখেছিলাম; সেদিন চারদিকটা নতুন মনে হয়েছিল। সূর্য দেখা গিয়েছিল একটু দেরিতে কিন্তুু সেই সূর্যও যেন ছিল নতুন সূর্য।
প্রকৃতির বুকে বসন্ত আসে, কোকিল কুহুকুহু ডাকে। চারদিক ফুলে ফুলে ভরে যায়। শীতে গাছের ঝরে যাওয়া পাতাগুলো জেগে উঠে। সবুজের সমারোহে চারদিক ভরে যায়। ফুলের সুবাসে চারদিক বিমোহিত হয়। আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ, ঝিঝির মোহিত গুঞ্জন।
আমাদের অত্র এলাকার মধ্য একটা পুরাতন মেলা ছিল বৌ-বান্নি মেলা। পূর্বে নাকি সেখানে বৌ বেচাকেনা হত সেই থেকেই নাকি এই নামকরন। একবার বাবা যাবেন বৌ বান্নি মেলায়; আমি জানতে পেরে ধরলাম জেদ, আমিও যাব। শেষ পর্যন্ত আমাকে না নিয়ে পারলেন না। বৌ-বান্নি মেলা যেখানে শুরু হয় তার পাশেই আমার বাবার মামার বাড়ি। বাবার ইচ্ছা ছিল সেখানে থাকবেন কিন্তুু আমার জন্য থাকতে পারলেন না। আমি জেদ ধরলাম বাড়ি আসব।
সেবার মেলা থেকে কাঠের তৈরী একটা খেলনা ট্রাক এনেছিলাম। সেটা দিয়ে রাস্তার ধুলা, এটা সেটা বহন করে খেলতাম। সেটার সামনে সুতা লগিয়ে টেনে টেনে নিয়ে বেড়াতাম।
আমি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি। একদিন স্কুলে গেলাম বাবা-মা এর চাপে। স্কুলে না যাওয়ার জন্য পূর্বে কয়েকদিন পেটনও খেয়েছি, বকা খেয়েছি তো বহুত। অবশেষে স্কুলের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মিল। আমি নিয়মিত স্কুলের ছাত্র হয়ে গেলাম। কত হাসি-কান্না নিয়ে চলতে লাগল আমার শৈশব। গ্রামের এক প্রান্তে প্রাইমারি স্কুল। স্কুলে একবার বন্যার পানি উঠেছিল। ঘরের ভেতর এক হাটুর মত পানি। তখন আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল কয়েকদিন। বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা স্কুল, পথের ধারে, সামনে ধানের জমি, স্কুলের চারপাশে কিছু ইউক্যালিপটাস বৃক্ষ। পতাকা উড়ত পতপত করে, লাল সবুজের পতাকা।
আমি গ্রামের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতাম দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি ইত্যাদি। তবে আমার এসব খেলার শুরু স্কুলে পড়ার পড় থেকে, তার আগে আমি একাই খেলতাম খেলনা দিয়ে। ফিরোজা আপাও আমাকে বেশ কিছু খেলনা দিয়েছিলেন।
আমাদের বাড়ি থেকে পূর্বে রাস্তার দক্ষিণ পাশে আমাদের যে বাঁশের বাগানটা সেটা ছিল আমাদের আবাদী জমি। আর তার পশ্চিম পাশে পাশাপাশি দুটো আমগাছ। আর গাছদুটোর দক্ষিণ পাশে আমার দাদা-দাদীর কবর। সেই একটা আমগাছের কারণে অন্যটার নাম বদলে গিয়েছিল। একটা ছিল কাচামিঠে; ফলে তার আম খাওয়া জুটত না, সারাদিন লোকের একটাই কাজ, সেই আম পাড়া। পরে সেটা কাটা হয়েছিল কিন্তুু সেটার কারণে পাশের গাছটার নাম যে ‘ট্যাঙ্গ্যা’ হয়েছিল তা আর পরিবর্তন হয়নি, অথচ কত সুন্দর মিষ্টি সেই গাছের আম। কিন্তুু গাছটাতে গত কয়েক বছর হল আর আম ধরছে না। জমিটাতে ফসল হত না মানুষের অত্যাচারে; তাই আমরা সেটাতে বাঁশ বাগান করেছি কয়েক বছর হল। বাশঝাড় বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার দাদা-দাদীর কবরটা পাকা করে বেধে দেওয়া হয়েছে অল্প কিছুদিন হয়। তার পাশে দাড়িয়ে আছে আমগাছটা অন্য সঙ্গী গাছটাকে ছেড়ে; যার কারণে আজ তার ঘাড়ে মিথ্যা অপবাদ সে আজ নেই তাই একা দাড়িয়ে আছে তাকে হারিয়ে।
আমি বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও তেমন যেতাম না তাই আমার জ্ঞান ছিল সীমিত। শৈশবে একদিন বাবার সঙ্গে গেলাম হাটে। হাট থেকে ফেরার সময় আমাকে সহ খরচ রেখে বাবা সাইকেল আনতে গেলেন গ্যারেজে। বাবা আসতে দেরি করছিলেন। এ সময় কে যেন একজন আমাকে বললেন,“তোর বাপ তোকে রেখে বাড়ি চলে গেছে”। আমি ভাবলাম গ্যারেজের পাশে যে বড় শস্য গুদামটি আছে, ইয়া বড় তালা তার, তাতে হয়ত বাবাকে আটকে রেখেছে। আমি কান্না জুড়ে দিলাম। বাবা এসে আমাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,“বাবা, কঁদছেন কেন?” মুখ তুলে তাকিয়ে আমি চমকে গেলাম, বাবা এসেছেন!
আমি ছোটবেলা থেকেই গল্প শুনতে ও বলতে ভালবাসতাম। এটি ছিল আমার প্রিয় কাজগুলোর একটি। আমি কোন গল্প একবার শুনলেই তা পরিস্কারভাবে মনে রাখতে পারতাম। পরে তা লোকজনদের সুনাতাম মধুর সুরে। গ্রামের চৌমাথায় কয়েকটি টিনের তৈরী দোকান ছিল। সেখানে বটগাছের তলায় আমি গল্প বলতাম। আমার বলা গল্প শোনার জন্য লোকজন চারদিকে গোল হয়ে বসতো; আমি থাকতাম মাঝে দাড়িয়ে নয়ত বসে। সকলে মুগ্ধ হয়ে আমার উপস্থাপনা শুনতো। হঠাৎ একদিন মাথায় এক ভিন্ন বুদ্ধি এলো; আমি গল্প শোনাতে শর্ত জুড়ে দিলাম, কিন্তুু তারা ভিন্ন বুদ্ধি খাটিয়ে বিভিন্ন প্রকারের ভয় দেখিয়ে, চালাকি করে তা পন্ড করে দিল।
শৈশবে আমরা খেলানোর জন্য একটা কাজ করতাম। একটা কলার গাছের লম্বা টুকরোকে মাটির নিচে কিছু অংশ পুতে দিয়ে তা কোমর খানেকের চেয়ে একটু নিচু করে তার উপরে আর একটা লম্বা কলাগাছের টুকরোকে আনুভুমিকভাবে রেখে তার মাঝে ও উলম্বটির মধ্যে সেই খুটি পুতে দিতাম। তারপর আনুভুমিক অংশটির দু’পাশে দুজন বসে থাকত আর দুজন সেটাকে ঘোরাত। দুজন বসে থাকত ও দুজন ঘোরাত, পালাবদল করে এই খেলা চলত। একে বলা হতো চরকি। পাশের বাড়ির রাজু ভাই ছিল আমার চেয়ে বয়সে বড়। সে এসবের নেতৃত্ব দিত; নতুন নতুন খেলা সে আমদানি করত আর আমাদের নিয়ে সেসব খেলায় মেতে উঠত।
আমাদের গ্রামটা দুই পুলের মাঝখানে। গ্রামের মাঝের রাস্তার পূর্বে কড়িতোলা পুল যা এখন ব্রিজ আর পশ্চিমে বটেত্তল পুল। সেই বটেত্তলে বর্ষার সময়ে কত ছেলেরা সাঁতার কাটতেন, দৌড় ঝাপ দিতেন, ছুল খেলতেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা সেই পানি দেখাতে নিয়ে যেতেন।
সেরূপ এক বর্ষায় পাশের বাড়ির মেয়ে তৃতীয় শ্রেনির ছাত্রী লাইজু কড়িতোলার পানিতে পড়ে ডুবে মারা যায়। তার পরিবার অনেক কাঁদে এবং আস্তে আস্তে তা শামসুর রাহমানের ‘একটি ফটোগ্রাফ’ কবিতার মতো ফল পায়।
এভাবে-? সময় কাটে, একসময় আমি হয়ে যাই প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসের বেস্ট বয়, স্বপ্ন এগোয়!
জীবনের গল্প ফুরোবার নয়-----------।
শৈশব ঝাপসা হলেও মধুর, যৌবন পরিস্কার হলেও নিরস।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন